দৃষ্টি ভঙ্গি


আমাদের আশে পাশে এমন অনেক কিছুই আছে যা আমরা দেখি কিন্তু কখনো অনুভব করি না।
তার চেয়ে বরং অন্ধ যারা, তারাই ভালো। তারা দেখতে পায় না ঠিকই কিন্তু প্রতিটি জিনিস অনুভব করে।।

কিছুদিন আগে এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেছি।বন্ধুটি একটা কাজে বাহিরে যাওয়ায় আমাকে বলল," তুই একটু আশে পাশে ঘোরা-ঘুরি কর, আমি এখনি চলে আসব।আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে
একা একা রাস্তা দিয়ে হাটছি।।পড়ন্ত বিকেল বেলা।আমি সূর্যকে পেছনে ফেলে কাচা রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছি।বেশ কিছুটা রাস্তা চলে এসেছি।পকেট হাতরে একটা সিগারেট বের করে জ্বালাতে যাব এমন সময় আমার চোখ পাশেই এক বাড়ির উঠানে গিয়ে আটকে গেলো।মোটামুটি বছর পঞ্চাশের একজন মহিলা একটা অর্ধসমাপ্ত হাতপাখা সেলাই করছেন।দূরে থেকেও পাখায় ফুটিয়ে তোলা নকশা আমাকে ভীষনভাবে আকৃষ্ট করছিল।

আশে পাশে বলতে আমি, আর কয়েকটা ৫-৮ বছরের ছেলে-মেয়েরা কিছুটা দূরে খেলা করছে।তিনি মাঝে মাঝে মুচকি হাসছেন আর এক মনে পাখার উপরে নকশা করে যাচ্ছেন। একটা পাখির নকশা।পাখিটা একটা ডালে বসে আছে আর তার চোখে যেন কোন একটা জিজ্ঞাসা!!
আমি পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম।প্রথমে ভেবেছিলাম, উনি বোধহয় দেখতে পান।কিন্তু যখন দেখলাম,উনি হাতরে হাতরে সেলাই করছেন তখন বেশ কৌতুহল নিয়ে উনার কাছা কাছি এসে দাড়িয়েছি।
কিছুক্ষন স্তম্ভিত হয়ে দেখছি;দেখি উনি কি করেন!
সেই মুহূর্তে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল।কারন আমার কাছে না আছে তখন ক্যামেরা না মোবাইল।সাধারন নকিয়া ১২০০ ফোনটা নিয়ে বাহিরে বের হয়েছি।আর ক্যামেরা ফোনটা ফেসবুক ব্যবহার করতে করতে দম ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে চার্জে লাগিয়ে এসেছি।কি করি, কি করি তাই ভাবছি।
এমন সময় মহিলা টা একটু মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন,"আপনি কে বাবা?  অনেকক্ষন ধরে দাড়িয়ে আছেন মনে হচ্ছে "।
আমি অবাক হয়ে গেলাম, আশ্চার্য, এই মহিলা কিভাবে টের পেলো!!
আমি আমতা আমতা করে বললাম," না না, এই তো কিছুক্ষন হলো এসছি।আপনার সেলাই দেখছিলাম।"
"আচ্ছা চাচীমা,আপনি তো চোখে দেখেন না;তাহলে কিভাবে সেলাই করেন? "
আমার প্রশ্ন শুনে মাতৃ স্নেহে মুখে একটা অকৃত্রিম হাসি টেনে বললেন," এখন দেখিনা।কিন্তু একসময় তো দেখতাম।আর কিছু করার জন্য কি সব সময় চোখে দেখতে হয়? মনের একটা চোখ আছে।এটা দিয়ে দেখলে বাকি দুটো চোখের আর দরকার হয় না"।

আমি উনার কথা যতই শুনছি আর উনার একমনে করে যাওয়া কাজ যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি।
মনে মনে ভাবলাম, রুমে যেয়ে ক্যামেরাটা নিয়ে এসে একটা ছবি নেব।
উনার সাথে আরো কিছুক্ষন গল্প করে বন্ধুর বাসায় ফিরে এলাম।তারপর রাতে ওকে সব খুলে বলতেই ও তো আরো অবাক।আমাকে বলল,"কই আমাদের গ্রামে তো এমন কেউ নেই।হয়ত বাহির থেকে কেউ এসছে। চল, আমিও দেখব মহিলাটা কে! "
পরদিন সকাল ১০ টার দিকে আবার গেলাম ওই বাড়িতে।এবার অনেক প্রস্তুতি। ক্যামেরা,রেকর্ডার ইত্যাদি ইত্যাদি।বাড়ির উঠানে কাউকে না দেখে ভেতর বাড়িতে কেউ আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম।এক ৭/৮ বছরের মেয়ে বের হয়ে এলো।তার পেছনে পেছনে ৬০/৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ।আমি সালাম দিয়ে আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য অবহিত করলাম উনাকে।সব শুনে উনি বললেন,"ওহ! আপনারা শেফালীর কথা বলছেন? ওইটা আমার ছোট বোন।এইতো ঘন্টা খানেক আগে এখান থেকে চলে গেলো।পরশু দিন আমেরিকা চলে যাবে আমার ভাগ্নের কাছে।"
আমার মনটা ভীষনভাবে খারাপ হয়ে গেলো। এত প্রস্তুতি সম্পুর্ন বৃথা হয়ে গেলো। ইস! কেনো যে এত ডেরী করলাম!!
যাই হোক,  বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলাম," উনি অন্ধ হলেন কবে থেকে? "
বৃদ্ধ লোকটি জবাবে বললেন," ওর বয়স যখন ১২ তখন থেকেই ও পুরো অন্ধ।কিন্তু মনোবল ছিল অনেক।আমরা যা করতে পারি নাই ও তাই করেছে দু চোখে না দেখে।"

মনে মনে ভাবলাম, সে তো আমরাও দেখলাম।আর সেই জন্যেই তো আসা।কিন্তু বিধি বেজার হলে যা হয়,তাই হয়েছে।

উনার একটা কথা আমার এখনো কানে বাজে, "এখন দেখিনা।কিন্তু একসময় তো দেখতাম।আর কিছু করার জন্য কি সব সময় চোখে দেখতে হয়? মনের একটা চোখ আছে।এটা দিয়ে দেখলে বাকি দুটো চোখের আর দরকার হয় না।"

------
এবার আসি পুর্বতন প্রসঙ্গে।
আসলেই আমাদের চারিপাশে এমন অনেক কিছুই আছে যা আমরা দেখি কিন্তু অনুভব করি না।আমি জানি না সেই উপলব্ধি আমাদের কখনো হবে কিনা।কবি যখন ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুকে হীরক,মনি মুক্তা দেখেন তখন আমরা সেই ঘাসের ডগায় জমা শিশিরে পায়ের ময়লা মুছবার পানি খুঁজি। আর কাঞ্চঞ্জঙ্ঘা দেখার জন্য লাখ টাকা ব্যয় করি কিন্তু কোনদিন সকালের উদীয়মান সুর্যের প্রতিচ্ছবি নদীর বুকে কেমন দেখায় দেখিনা। গোধূলির রং কিভাবে আকাশের মেঘকে রাঙিয়ে দেয় তাও দেখার চেষ্টা করিনা।
আসলে সব কিছুই নির্ভর করে আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গির উপর।
এবার আমাদের ডিসিশন নেবার পালা আমরা কোনটাকে কিভাবে দেখবো।।।।

https://m.facebook.com/profile.php?id=192890780905264
www.facebook.com/swopnonil

No comments:

প্রিয় দেবী (বিরহের চিঠি) ৩

প্রিয় দেবী, অনেকদিন পর তোমায় লিখছি। কতদিন পর! ঠিক ঠাক মনে পড়ছেনা কিছুই। শুধু মনে পড়ে, শত শত চিঠি পাঠিয়েছি বেনামী ঠিকানায় বহুদিন। হয়ত সেসব কখ...