নায়িকা ও আমি নীলকান্তঃ ১
#১
গল্পের নায়িকাকে বারবার ফ্লাশব্যকে যেতে দেখে শুধালাম,
" তা আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি? "
নায়িকা উত্তরে বললেন,"যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন ভাবতাম ডাক্তার হবো। তারপর আরেকটু বড় হয়ে শিক্ষিকা হবার শখ।"
এবার আমি জোড় করে তাকে বর্তমানে টেনে আনলাম,"ওহ হো,একটা কথা বলতে তো ভুলেই গেছি! "
নায়িকা উচ্ছাসিত কন্ঠে বললেন,"কি? কি? "
"না, মানে আপনার হাসব্যান্ড কই থাকেন?" একটু নীচু স্বরে বললাম।
এবার নায়িকা তার নিজের আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, "আমার বয়স কি খুব বেশি মনে হয়? "
আমি বললাম, "ছি ছি,তা কেন! আপনাকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবেনা আপনার বিয়ে হয়েছে? "
এবার নায়িকা কিছুটা লাজুক হেসে বললেন," আপনার যে কথা! আমার তো আসলেই বিয়ে হয়নি! "
মনে মনে ভাবলাম , তা তো বটেই। বিয়ে হবে কি করে! যার পাষ্টটা এত রোমাঞ্চকর, তার বিয়েটা একটু দেরীতে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তা না হলে এত মধুর মধুর স্মৃতির জন্ম হত কোথা থেকে!
ভেতরের ভাবটা জোর করে চেপে রেখে অতি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,"তাই নাকি? বিশ্বাসই করতে পারছি না। আমি ভাবতেও পারিনি আমার ধারনা টা মিলে যাবে! আমি মনে মনে সেটাই ভাবছিলাম বটে।"
আমার অতি উৎসাহ দেখে নায়িকা বেশ খুশিই হলেন।লাজুক মুখটা একটু নীচু করে, নিজের বাম হাতের আঙুলের নখ দাঁতের নীচে দিয়ে হেসে হেসে বললেন, "জানেন, এই গত কয়দিন আগেও বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। প্রায় প্রতিদিনই আসে।আমিই নাকচ করে দেই।"
আমি কৃত্রিম কৌতুহলে জিজ্ঞাস করলাম, "কেন কেন? "
"এই ঠিক মত ছেলে পাইনা তাই। কেউ কেরানীর চাকুরী করে,কেউ দপ্তরি,কারো আবার বউ মারা গেছে!
আপনিই বলেন,এদের সাথে আমার কি যায়? " নায়িকা কিছুটা অভিমান নিয়ে বললেন।
আমি বললাম, "নাহ! কিছুতেই না।এসব লোকজন আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার সাহস পায় কি করে! ছি ছি! আপনি কি এতটাই ফেলনা হয়ে গেছেন নাকি?
' তা ম্যাডাম, আপনার কি ধরনের ছেলে পছন্দ? "
এবার নায়িকার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। লজ্জাবনত মুখে লাজুক হেসে বললেন,"এই আপনার মত।স্মার্ট, লম্বা,সুন্দর দেখতে,স্বাস্থ্য ভালো, সুন্দর করে কথা বলতে পারে এমন কাউকে।"
এতক্ষনে নায়িকা যে লজ্জা পাচ্ছিলেন তার চেয়ে দশগুণ বেশি লজ্জা পেলাম আমি। মনে মনে বললাম,বলে কি রে!
নায়িকার কথা তখনো শেষ হয়নি।তিনি কথার সাথে আরো যোগ করলেন, "আপনার মত শ্যামলা হলেও চলবে।জানেন,আপনাকে না অপূর্বর মত লাগে! "
লজ্জা পাওয়ার আরো কিছু বাকি ছিল ঠিক ভাবিনি।শেষের কথাতে আরো বেশিই লজ্জা পেলাম। বলে কি?
কোথাকার কি,পান্তাভাতে ঘি! কই অপূর্ব আর কই নীলকান্ত!
তবে এই তুলনা যে প্রথম শুনছি ঠিক তা না।এর আগে কমছে কম হাজার জন একই কথা বলেছেন।যদিও আয়নার সামনে দাড়ালে ঠিক বিশ্বাস হয়না, আর মিলাতেও পারি না।
যাই হোক,
যে পাঞ্চগুলো এতক্ষন আমি নায়িকাকে দিচ্ছিলাম,নায়িকা তা যে এভাবে ফেরত দেবেন তা ভাবতে এবং বুঝে উঠতে একটু সময় লেগে গেলো।
আমি নায়িকাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, "কি যে বলেন আপনি! কোথায় আমি আর কোথায় অপূর্ব! আর আপনার মত মেয়ে আমার মত ছেলেকে পছন্দ করবেন কেন? আপনার আরো ভালো ছেলের সাথে বিয়ে হবে,দেখবেন।"
নায়িকা এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন।কি যেন বলতে চেয়েও বললেন না। এদিকে আমি কোন মত এই স্থান ত্যাগ করবার অভিপ্রায়ে কাঁচুমাচু করছি।বারবার রিষ্ট ওয়াচটার দিকে তাকাচ্ছি আর ভাবছি, কি বলে এখান থেকে উঠা যায়! সময়ও কম হলো না,সাড়ে পাঁচটা মত বাজে। আমি রিষ্ট ওয়াচ থেকে মুখটা তুলে নায়িকার মুখটা ওয়াচ করবো বলে যেই না তাকিয়েছি ওমনি অবাক হয়ে দেখলাম, একি! নায়িকা যে কাঁদছেন!!
কিন্তু কেন, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি তাকাতেই তিনি তার উড়নার আচল দিয়ে চোখ মুছলেন। কিছুটা বিব্রত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
"ম্যাডাম, আমি কি কোনভাবে আপনাকে কষ্ট দিয়েছি? প্লিজ নিজের অজান্তে কোন ভুল করলে ক্ষমা করবেন। "
এবার নায়িকা তার চোখের জলে ভেজা আচলটা হাতের আঙুলে জড়িয়ে আবেগাপ্লুত কন্ঠে বললেন,
"এত দিন অনেক মানুষের সাথে কথা বলেছি,কিন্তু কেউ আপনার মত করে আমার সাথে কথা বলেনি। সবাই আমার দূর্বলতার সুযোগ খুঁজেছে। একমাত্র আপনার সাথে কথা বলে আজ যত ভালো লাগলো, তা আমি কোনদিন ভুলবো না। গত দুই ঘন্টা আমার কাছে আজীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে।"
নায়িকা আর কিছু বললেন না।কেমন যেন চুপসে গেলেন।এদিকে আমার নিজের কাছে নিজেই খুব বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। একজন মানুষ তার অতীতের দুঃখগুলো আমার সাথে শেয়ার করছিলেন কিন্তু আমি? আমি স্বার্থপরের মত তার কথা গুলোকে নিছক বাজে অতীত ভেবে কিভাবেই না অগ্রাহ্য করেছি! তারপর আবার এখান থেকে পালানোর জন্য পথ খুঁজছি। ছি ছি! আমি এতটা স্বার্থপর??
নায়িকাও নীরব,আমিও নীরব। ড্রয়িং রুমের সিলিং ফ্যানের শ শ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। বেশ কিছুক্ষন এভাবে যাবার পর নায়িকাই প্রথমে কথা পারলেন,
"নীল,আজ আপনি আমার বাসায় ডিনার করে যান।ফ্রিজে মাংশ আছে আর আমি ভালো বিরিয়ানি করতে পারি।আপনার অনেক ভালো লাগবে।"
আমি স্বাভাবিক ভদ্রতা বশত বললাম,না না।তার দরকার নেই।আজ আপনার সাথে ডিনার করতে পারছি না।অন্য কোনদিন নিশ্চয়ই করবো।
আজ যে আমাকে উঠতে হচ্ছে! প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। "
নায়িকা এবার ধরা গলায় বললেন, "হোক না! আজ ডিনার টা করে যান।আর কোনদিন আসবেন কি না, তা বলা যায় না।
অন্তত আজকে,প্লিজ।"
একবার ভাবছি,অনুরোধ টা রাখি।আবার মনে হচ্ছে,নাহ! আজ আর না। শেষপর্যন্ত ভাবনার দোলাচালে ২য় সিদ্ধান্তটাই স্থির করলাম।
উঠে দাঁড়িয়ে নায়িকাকে বললাম, আজ আমাকে উঠতেই হচ্ছে।সন্ধ্যার পরে বিশেষ একটা কাজ আছে। প্লিজ মন খারাপ করবেন না।।
নায়িকা এবার দাবির সুরে বললেন,"কাজটা কি খুব জরুরী? "
বললাম,"হ্যা।বেশ জরুরী। "
নায়িকা বললেন, "ঠিক আছে,খুব জরুরী কাজ থাকলে যান।কিন্তু কথা দিতে হবে, আরেকদিন আসবেন।"
আমি মুচকি হেসে মেইন দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বললাম,
যদি সৃষ্টিকর্তা আবার কখনো সুযোগ দেন,তবে অবশ্যই আসবো।
নায়িকা আমাকে মূল রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, "অবশ্যই দেবেন।আর দিতেই হবে।
আপনার সাথে ২য় বার দেখা না হওয়া পর্যন্ত আমি মরতে চাই না।"
কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে নায়িকার মুখের দিকে তাকালাম। তার চোখে ছলছল জল,সকরুণ আহবান। সেখানে কোন কৃত্রিমতা নেই।না আছে অন্য কোন কিছু। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। একটা খালি রিকশা আসতেই দ্রুত উঠে পড়লাম।একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে বললাম,"ভালো থাকবেন।"
Nilkanto( নীলকান্ত)