একগুচ্ছ অর্কিড আর একটি লাল গোলাপ

একগুচ্ছ অর্কিড আর একটি লাল গোলাপ
    by Tonmoy Parthib


  ১
সকাল থেকেই আকাশটা কেমন মুখ গোমড়া করে বসে আছে।মেঘগুলোও অনবরত গুড় গুড় করে ডেকেই চলেছে।বৃষ্টি আসা যে সময়মাত্র তা মিতু আগেই টের পেয়েছিলো।মিতুর অবশ্য আষাঢ়ের এই বৃষ্টিভেজা দিনগুলো খারাপ লাগে না।বৃষ্টির এই দিনগুলো শুরু হলেই মিতুর মনে পরে যায় জাকিরের সাথে তার প্রথম দেখা হওয়া দিনটির কথা।

আজ মিতুর দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী।আজকের এই দিনটা শুধু জাকিরের সাথে কাটাবে বলেই নিজেকে আলাদা করে রাখা তার।জাকির অফিসের কাজে তিনদিন হল ঢাকার বাহিরে গিয়েছে।আজকেই তার ফিরবার কথা।কিন্তু বারবার জাকিরের ফোনে কল করার চেষ্টা করলেও মিতু ফোন অফ পাচ্ছে শুধু।রাগ হচ্ছে তার কিন্তু সে জাকিরের উপর আজ কোন রাগ করবে না।কারণ মিতু জানে তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য জাকির এমন কাজ মাঝে মধ্যেই করে থাকে।এইতো এক মাস আগে,মিতুর জন্মদিনের আগের রাত থেকে জাকির ফোন অফ করে বাহিরে ছিল।ঠিক রাত বারোটা বাজার সাথে সাথেই হাজির হল একগুচ্ছ অর্কিডের মাঝে একটি লাল গোলাপ নিয়ে।সে রাতের মিতুর জমানো রাগগুলো আর প্রকাশ করা হয়নি।করবেই বা কিভাবে সাদা অর্কিডের মাঝে লাল গোলাপ তার যে সবচেয়ে প্রিয় বিন্যস্ত ফুল।আজও হয়ত এমন কোন সারপ্রাইজ দিবে বলেই জাকিরের এই ফোন অফ রাখা।আর মিতুর অপেক্ষার প্রহর বর্ধিত হওয়া।

বৃষ্টির প্রকোপতা সময়ের সাথে সাথে বেড়েই চলেছে।মিতুও হারিয়ে গেল এই বর্ধিত প্রহরে কিছু পুরনো সুখ স্মৃতি রোমন্থনে।আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এমনি বরষা বাদল দিনে মিতু আটকা পরেছিল তার ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দায়।হটাত পাশ থেকে ওর বান্ধবী বলে উঠল,মিতু দেখ ঐ ছেলেটি বারবার তোর দিকে তাকাচ্ছে আর কি যেন আঁকিবুঁকি করছে।মিতুও খেয়াল করল ব্যাপারটা কিন্তু উৎসাহ দেখানোর প্রয়োজন বোধ করল না।মিতুর বান্ধবী অবশ্য ছেলেটা কি করছে এই উৎসাহ চাপা দিতে না পেরে দেখতে গেল।দেখে এসে জানালো,ছেলেটি নাকি মিতুর ছবি আঁকছে।মিতুর একটু বিরক্ত লাগল,সে সোজা চলে গেল ছেলেটির কাছে।সরাসরি তাকে জিজ্ঞাসা করল,তার অনুমতি না নিয়ে কেন তার ছবি আঁকছে?মিতুর প্রশ্নে ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও দমে যায় নি,শুধু বলে উঠল,আপনি কি এখানে একটু বসবেন প্লীজ?
মিতু বলল,কেন?
তখন ছেলেটি বলল,আমি আজকেই প্রথম আপনার ছবি আপনাকে না জানিয়ে আকি নি,এর আগেও এঁকেছি।এই খাতাটায় ামার আঁকা আপনার সব ছবিই আছে।আপনি চাইলে দেখতে পারেন।ভালো না লাগলে ছিঁড়ে ফেলবেন,আবার শাস্তি স্বরূপ খাতাটা আপনিও নিয়ে যেতে পারেন।
মিতু ছেলেটির কথায় অবাক হয়ে গেল,আজকেই প্রথম আঁকছে না জেনে তার জানার,দেখার আগ্রহ ভিতরে ভিতরে বেড়ে গেল।সে ছেলেটিকে কিছু না বলেই তার হাত থেকে খাতা কেড়ে নিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগলো।হটাত একটি ছবিতে এসে সে স্তব্ধ হয়ে গেল।শুধু ভাবতে লাগল এটা কি করে সম্ভব!কেননা এই হাসিটা মিতু শুধু তখনই দেয় যখন সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মনের সাথে কথা বলে।তার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্তের ছবি এটি যা শুধু নিজের আর একান্ত আপন মানুষটির জন্য তুলে রেখেছে সে।
ছবিটি দেখার পর মিতু তার মুগ্ধতার আলোড়নে সাড়া দিয়ে বাহিরের বৃষ্টির পানে পা বাড়াল।বাহিরের বৃষ্টি এখন তার কাছে কোন বাঁধা মনে হচ্ছে না।আশপাশের সবকিছু ক্রমশ তার আপন মনে হতে লাগল।মিতুর হটাত এমন আচারন তার বান্ধবী আর ছেলেটির কাছে বোধগম্য না হলেও মিতু সেসবের ধার না ধরে ছুটে চলতে লাগল আপন মোহে।মিতুর শুধু মনে হতে লাগল,আজ যদি কেউ তার সামনে কোন শক্ত পাথুরের দেওয়ালও দাড় করিয়ে দেয় সে তাও ভেদ করে যেতে পারবে।

তারপর কিভাবে কখন ছেলেটির জন্য তার মনে জায়গা হয়ে গিয়েছে মিতু তা নিজেও জানে না।শুধু জানে এমনি এক আষাঢ়ের বরষা মুখর দিনে জাকির তার হলের সামনে ভিজতে ভিজতে এসেছিল একগুচ্ছ অর্কিডের মাঝে একটি লাল গোলাপ হাতে নিয়ে।আর বলেছিল,চল বৃষ্টিতে ভিজি।মিতু সেদিন কোন কথা বলে নি, শুধু রুম থেকে নিয়ে আসা ছাতিটা রেখে দিয়ে জাকিরের সাথে হাঁটা শুরু করেছিল।আর হাটতে হাটতে বৃষ্টির ফোঁটায় মিশে যাওয়া অশ্রু জল না মুছে জাকিরের হাতে হাত রেখেছিলো।

মিতু ইংরেজিতে পড়লেও তার ডিজাইনের প্রতি আলাদা একটা ঝোঁক ছিল।সে সাদা শাড়ি আর লাল পারের কাপড় কিনে সাদার মাঝে নকশা আর রঙের খেলা খেলতে ভালবাসত।আজকেও জাকিরকে সারপ্রাইজ দিবে বলে তার নতুন নকশা করা সাদা শাড়িটা পড়ে আছে সে।কিন্তু জাকিরের ফোন এখনও অফ হয়েই আছে।

দুপুর তিনটা বাজে।জাকির বলেছিল বারোটার ভিতর বাসায় পৌঁছুবে।আর প্রতিবারের মত এই দিনটাতে তারা একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবে।বাহিরের বৃষ্টির প্রকোপতা কিছু না কমে যেন আরও বেড়েই চলেছে।মিতু ভাবতে লাগল,হয়ত আজ তাদের দুজনকে আবারো একসাথে ভিজাবে বলেই বৃষ্টি তার বর্ষণ ধারা অব্যাহত রেখেছে এখনো।
হটাত জাকিরের গাড়ীর হর্ন শুনে মিতুর ভিতরে সেই প্রথমদিনের মতন অজানা কিন্তু ভাললাগা অনুভূতির দোলা খেলে গেল।ছুটে চলল দরজা খুলে।সিঁড়ী বেয়ে নীচে নামতেই তার চোখে পড়ল গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে সাদা কাপড়ে মোড়া নীরব নিস্তেজ একটি শরীরকে।
সেই নিথর শরীরের ছিন্নভিন্ন অংশ থেকে বের হওয়া রক্তের স্রোত সাদা কাপড় ভেদ করে বাহিরে চলে আসছে। আর তার পাশে পড়ে রয়েছে একগুচ্ছ অর্কিডের মাঝে একটি লাল গোলাপ।
আর মাত্র এক ধাপ কিন্তু রিমির পা কেন জানি দৃশ্যমান শরীরের কাছে অদৃশ্য মায়াজালে বাঁধা পড়ে গেলো।শত চেষ্টাতেও এ বাঁধা ডিঙাতে পারছে না সে।যখন নিঃশেষিত শক্তির পুরোটা দিয়ে বাঁধা পেড়িয়ে মিতু জাকিরের সেই নিস্তেজ,নিথর শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল,তখন মিতুর সাদা কাপড়ে লাল রঙের নতুন খেলা শুরু হল,যে খেলা বৃষ্টির প্রকোপতাও বন্ধ করতে পারছে না।

No comments:

প্রিয় দেবী (বিরহের চিঠি) ৩

প্রিয় দেবী, অনেকদিন পর তোমায় লিখছি। কতদিন পর! ঠিক ঠাক মনে পড়ছেনা কিছুই। শুধু মনে পড়ে, শত শত চিঠি পাঠিয়েছি বেনামী ঠিকানায় বহুদিন। হয়ত সেসব কখ...